আমি একজন ব্যবহার থেরাপিস্ট হিসেবে প্রতিদিন এমন অনেক শিশুর সঙ্গে কাজ করি, যাদের আচরণ সাধারণ শিশুদের থেকে আলাদা। অনেক সময় অভিভাবকরা খুব দুশ্চিন্তায় থাকেন—”আমার সন্তান কি স্বাভাবিক?”, “সে কেন কারো সঙ্গে কথা বলে না?” অথবা “কেন একই কাজ বারবার করে?” এসব প্রশ্ন থেকেই শুরু হয় অটিজম বোঝার যাত্রা।
অটিজম একধরনের নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার—মানে মস্তিষ্কের বিকাশে কিছু সমস্যা থাকে। সাধারণভাবে, শিশুর বয়স যখন ১ থেকে ৩ বছরের মধ্যে থাকে, তখনই আমরা লক্ষ করি যে তার যোগাযোগ, আচরণ ও মিথস্ক্রিয়ায় (ইন্টারঅ্যাকশন) কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছে।
আমরা কী লক্ষ করি?
একজন থেরাপিস্ট হিসেবে আমি প্রথমেই যে বিষয়গুলো দেখি তা হলো:
-
শিশু চোখে চোখ রেখে কথা বলে কি না
-
ডাক দিলে সাড়া দেয় কি না
-
প্রয়োজন বোঝাতে ইশারা করে কি না
-
একই খেলনা বা কথা বারবার ব্যবহার করে কি না
-
নতুন পরিবেশে গিয়ে কীভাবে আচরণ করে
এই আচরণগুলো যদি বয়স অনুযায়ী না ঘটে, তবে সেটি আমাদের জন্য সতর্কবার্তা হতে পারে।
কিছু সাধারণ লক্ষণ
-
সামাজিক যোগাযোগে অসুবিধা: অন্যের সঙ্গে মিশতে চায় না বা পারে না
-
ভাষাগত সমস্যা: কথা বলে না, অথবা অপ্রাসঙ্গিক শব্দ ব্যবহার করে
-
পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ: এক কাজ বারবার করা, যেমন—ঘুরে ঘুরে চলা বা একই কথা বারবার বলা
-
তীব্র সংবেদনশীলতা: হালকা শব্দ বা আলোতেও অস্বস্তি
আমরা কীভাবে কাজ করি?
ব্যবহার থেরাপির মূল লক্ষ্য হলো শিশুর প্রতিদিনের জীবনে প্রয়োজনীয় দক্ষতা গড়ে তোলা। যেমন:
-
যোগাযোগ শেখানো (কথা বা ইশারা দিয়ে)
-
মনোযোগ ধরে রাখা
-
অন্যদের সঙ্গে খেলায় অংশ নেওয়া
-
রুটিনে থাকার অভ্যাস তৈরি
প্রথমেই আমরা ABA (Applied Behavior Analysis) পদ্ধতি ব্যবহার করি। এতে শিশুর প্রতিটি ছোট ছোট আচরণ লক্ষ্য করে ধাপে ধাপে তাকে শেখানো হয়—কীভাবে সাড়া দিতে হয়, কিভাবে চাওয়া প্রকাশ করতে হয়, কীভাবে সঠিকভাবে আচরণ করতে হয়।
সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ
শিশুর বয়স যত কম, থেরাপির সুফল তত বেশি পাওয়া যায়। ২ থেকে ৫ বছর বয়সের মধ্যেই যদি সমস্যা চিহ্নিত করে থেরাপি শুরু করা যায়, তাহলে শিশুর বিকাশে অনেক বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব। তবে বয়স বাড়লে এই উন্নতি ধীর হয়।
চিকিৎসা বলতে কী বোঝায়?
অটিজমের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই, তবে সহায়ক থেরাপি থাকে:
-
স্পিচ থেরাপি: কথা বলা ও বোঝার দক্ষতা বাড়ায়
-
অকুপেশনাল থেরাপি: দৈনন্দিন কাজ শেখায় (যেমন: খাওয়া, জামা পরা)
-
স্পেশাল এডুকেশন: বিশেষ স্কুলে শেখানোর মাধ্যমে শেখার পদ্ধতি বদলে যায়
-
পারিবারিক গাইডেন্স: মা-বাবা কীভাবে শিশুর সঙ্গে ব্যবহার করবেন, তা শেখানো হয়
আমার পরামর্শ
আমি সব সময় বলি, “আপনার শিশুকে আপনি সবচেয়ে ভালো চেনেন। যদি কিছু অস্বাভাবিক মনে হয়—দেরি করবেন না।” শিশুর বয়স অনুযায়ী তার বিকাশ হচ্ছে কি না, তা নজরে রাখুন। সময়মতো বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলে অনেক শিশুই স্বাভাবিক জীবনের অনেকটা কাছে চলে আসতে পারে।
অটিজম কোনো অভিশাপ নয়। এটি বোঝা, গ্রহণ করা এবং সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করার বিষয়। আমাদের একটু সচেতনতাই বদলে দিতে পারে একটি শিশুর জীবন।